সাক্ষাৎকার: জি এম কাদের
রাজনীতি এখন গুটিকয়েক গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে
বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরিজীবন শেষে জি এম কাদের সপ্তম, অষ্টম, নবম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর পুরো নাম গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই। শেখ হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রিসভায় তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার ও মাসুদ রানার সঙ্গে।
আজকের পত্রিকা: হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে কি?
জি এম কাদের: আমার কাছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা খুব ভালো মনে হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকেই যেন বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। কোনো পক্ষই পেছনে হটতে চায় না। তাই আগামীতে সংঘর্ষ অনিবার্যই বলা যায়। রাজশাহী বিএনপির স্থানীয় যে নেতা প্রধানমন্ত্রীকে কবরে পাঠানোর কথা বলেছেন, সেটা সম্ভবত মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া একটি কথা। এটাকে খুব বেশি সিরিয়াসলি না নিলেও চলত বলে আমি মনে করি। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা যেহেতু বিদ্বেষপূর্ণ, সেহেতু এ কথা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্ব শুরুতেই এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলে পরিস্থিতি এতটা বিস্ফোরণোন্মুখ না-এ হতে পারত। আমার মতে, এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানোটাও ঠিক হচ্ছে না।
অথচ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। ছাড় দিলে সেই পক্ষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে; বিশেষ করে সরকারপক্ষ পশ্চাদপসরণ করলে তাদের আরও বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু যা হচ্ছে তাতে রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভ হচ্ছে, সেটা ভাবার বিষয়। উত্তেজনা ছড়ালে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। তাই দেশ ও জাতির জন্য এসব ব্যাপার মঙ্গলজনক হবে না।
আজকের পত্রিকা: আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হবে বলে মনে করেন?
জি এম কাদের: দেশের সব মানুষই চাইছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক। আসলে নির্বাচন তো হয়ই জনগণের মতামতটা ভোটের মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়ার জন্য। আর সেই মতামতের ভিত্তিতে যেন পরবর্তী সময় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এটা তো একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটাকে যাঁরা অস্বাভাবিক ভাবেন, তাঁদেরই স্বাভাবিকত্ব নেই।
আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশের রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করেন এবং তাঁরা ক্ষমতায় থেকে এমন কতগুলো কাজ করেন যে কারণে জনগণের মুখোমুখি হতে, অর্থাৎ নির্বাচনকে ভয় পান। জনগণের কাছে সরাসরি জবাবদিহি করতে চান না। ক্ষমতা পেলে তার অপব্যবহার করেন। অবশ্য এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। নির্বাচনী পরিস্থিতিকে নিজের আওতায় নিয়ে এসে নির্বাচন করা এবং প্রয়োজন বোধে একে প্রতিহত করা—এটা স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসছে। আমরা ক্ষমতায় থাকতেও একই কাজ করেছি। নির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৯১ সালের পর থেকে এটা বেশি করে দেখা যাচ্ছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। শুধু সে সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে কোনো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এর আগে ও পরে প্রতিটি সরকারই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করেছে, আয়ত্তে নিয়েছে ও দলীয়করণ করেছে। নির্বাচন কমিশনে নিজেদের লোকদের নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
এরশাদ সাহেবের আমলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের কেয়ারটেকার সরকার সংবিধানসম্মতভাবে হয়নি। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজাল। তখন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত। ওই আন্দোলনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন প্রোগ্রামে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে চিরস্থায়ী করা হবে। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল হলো। এরপর নির্বাচনী ব্যবস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে থাকল। কিন্তু ২০০৬ সালে নির্বাচনকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার জন্য বিএনপি দলীয় লোকজন দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার চেষ্টা করায় আমরা তার প্রতি আস্থা রাখতে পারলাম না। তখন আমরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলাম। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনও যথার্থ সংবিধানসম্মতভাবে হয়নি। সংবিধানের কথা সবাই বলে, কিন্তু কেউই তা মানেনি। নির্বাচনব্যবস্থাকে নিজেদের আয়ত্তে এনে নির্বাচন করতে চায়। এ পরিস্থিতি দেশটাকে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে আমাদের দলের বক্তব্য হলো, বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ খুবই কম।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এখন দলীয় কর্মীদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই কারণে সরকারের ইচ্ছার বাইরে তাঁদের কিছু করার নেই। জনগণ রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তাদের বিরাজনীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি এখন গুটিকয়েক গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে।
আজকের পত্রিকা: এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী?
জি এম কাদের: আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশে এখন সব বিষয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে জাতীয় পার্টি যে এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার অবস্থায় নেই, সেটা আমরা বুঝি। ৩২-৩৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় আমাদের অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল। যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, সবাই আমাদের নাজেহাল করার চেষ্টা করেছে। আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠিকমতো করতে দেওয়া হয়নি। দলের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছে। প্রায় সব সরকারের সময়ই সেটা করা হয়েছে।
সে কারণে আমরা মনে করি, এ সময়ে আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা প্রয়োজন। এটা শুধু দলের জন্য নয়, দেশের মানুষের প্রয়োজনেও এটার দরকার আছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে সাধারণভাবে দুটি শক্তি বারবার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু দেখা গেছে, ভালোর চেয়ে তারা খারাপ হওয়ার প্রতিযোগিতা বেশি করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মূল্যায়নে বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছে। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পরপর চারবার দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করেছে। বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুরু করেছিল। যা-ই হোক, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এল, তারা কিন্তু এটা বন্ধ করল না। এটা এখন বাড়তে বাড়তে এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। আমরা যতই বড়াই করি না কেন, বিশ্ববাসীর কাছে আমরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছি।
একজন খারাপ কাজ শুরু করেছে, কিন্তু আরেকজন সেই খারাপটাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে দেশের মানুষ মুক্তি খুঁজছে। কিন্তু দেশে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নেই। আমরা মনে করি, এই পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টি জাতির সামনে আশার আলো জ্বালিয়ে দিতে পারে। জাতীয় পার্টি কোনোভাবেই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হতে চায় না। স্বতন্ত্রভাবেই দাঁড়াতে চায়।
এরশাদ সাহেব যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন দেশে তুলনামূলকভাবে সুশাসন ছিল, উন্নয়নও চলছিল, জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হচ্ছিল। দেশ যখন রাজনীতির দুষ্টচক্র ও জাঁতাকলে পড়ে গেছে, তখন আমরা আমাদের বক্তব্য জনগণের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। এতে বিকল্প শক্তির জায়গায় আমরা যেতে পারব বলে মনে করি।
আজকের পত্রিকা: জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবির বিরোধের কথা শোনা যায়। এর কারণ কী?
জি এম কাদের: ভাবির সঙ্গে আসলে আমার কোনো বিরোধ নেই। এই বিরোধটা সরকার করে রেখেছে। সরকার বিভিন্নভাবে এটাকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। নানা ধরনের প্রচারণার কারণে অনেকে ভাবেন জাতীয় পার্টিতে কোন্দল আছে। আমরা যেন স্বাধীনভাবে না চলতে পারি, সে জন্য গলায় একটা শিকল লাগানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এর আগেও আমাদের নানাভাবে শিকল লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে আমরা মনে করি না যে এসব টিকবে। কারণ জনগণের সমর্থন একটা বড় বিষয়। তাই আমরা নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি বেশি জোর দিচ্ছি। দেশে যদি আবার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সত্যিকার অর্থে রাজনীতিতে দেশের মানুষের ভূমিকা প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে এ বিষয়গুলো আর টিকবে না।
আজকের পত্রিকা: দেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির প্রভাবের কথা বারবার শোনা যায়। আপনি কী মনে করেন, বিদেশি শক্তির কোনো প্রভাব আছে?
জি এম কাদের: বিদেশিরা আমাদের দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চান না, আমি এটা বিশ্বাস করি। বিদেশিরা সহজভাবে একটা কথা বলছেন, তাঁরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। দেশের বেশির ভাগ জনগণ এটার সঙ্গে একমত। কেন তাঁরা এসব বলছেন? এ ক্ষেত্রে তাঁদের সুস্পষ্ট যুক্তি আছে। বিশ্বের কিছু দেশ এখানে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছে। এখানকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের ব্যবসা জড়িয়ে আছে।
এখানে আমাদেরও স্বার্থ আছে। দেশ ভালো চললে আমরাও ভালো থাকব। আমরা মনে করি, এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। ফলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। তারা তো জোর করে কিছু বলছে না। আর আমেরিকার যুক্তিটা স্পষ্ট। বৃহৎ শক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী শান্তির জন্য তারা নজরদারি করার চেষ্টা করে। তারা মনে করছে, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জবাবদিহিহীন সরকার বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি। এ কারণে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
আজকের পত্রিকা: যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে কোন বক্তব্য দিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইবে?
জি এম কাদের: আমরা এখন বলতে চাই, জাতীয় পার্টির সরকারের সময় জনগণ ভালো ছিল। এখন পর্যন্ত আমরা এমন কিছু কাজ করিনি, যেটা জনগণের কাছে খারাপ হয়েছে। আমরা জনগণের পক্ষে ছিলাম, আগামীতেও থাকব।
আমরা সুশাসনের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি—মানে আইনের শাসন, ন্যায়বিচারভিত্তিক এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আর একটা হলো, আমরা নিরাপত্তার বিষয়ে জোর দেব। সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে যে সাহায্য পাওয়ার কথা, সেটা পাচ্ছে না। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলো উন্নয়নের বাহন। কিন্তু জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন যদি না হয়, তাহলে শুধু এসব উন্নয়ন দিয়ে তাদের কিছু হয় না। দেশে এখন চলছে মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি। এগুলোই আমাদের পার্টির বক্তব্য।
নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি এবং সাধারণ জনগণ কী চায়, তা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। যেহেতু রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক না, তাই চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
জি এম কাদের: আপনাদেরও ধন্যবাদ।